ছবি : বাম থেকে পিপি এড. ফরিদুল আলম, সাক্ষী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ, অতিরিক্ত পিপি এড. মোজাফফর আহমদ হেলালী ও এপিপি এড. জিয়া উদ্দিন আহমদ।
মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ অকাট্য আইনী যুক্তি ও এভিডেন্সের পক্ষে দৃঢ় জবানবন্দি দিয়ে আদালতে সাক্ষ্য প্রদান ও আসামীদের পক্ষে আইনজীবীদের জেরার সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছেন। এ মামলার ষষ্ঠ দফায় সাক্ষ্য গ্রহনের তৃতীয় দিন বুধবার ২৭ অক্টোবর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে তিনি এ সাক্ষ্য ও জেরার জবাব দেন। আসামীদের পক্ষে আইনজীবীদের জেরায় তিনি দৃঢ় মনোবল নিয়ে জবাব দেন।
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ তাঁর আদালতে এ মামলার ৯ জন আসামী ও ৪ জন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী গ্রহন করেন। ১৬৪ ধারায় গ্রহণ করা প্রতিজনের জবানবন্দী সঠিক পন্থায়, যথাযথ বিধি ও আইনী প্রক্রিয়া অবলম্বন করে হাইকোর্টের এম-৮৪ ফরমে লিপিবদ্ধ করেছেন বলে তিনি সাক্ষ্যতে আদালতে তুলে ধরেন। এ বিষয়ে তিনি অবিচল ও অটল ছিলেন। প্রতিজনের নেওয়া জবানবন্দী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ আদালতে exhibit (প্রদর্শন) করান। প্রত্যেকে স্বেচ্ছায় আদালতে এসে জবানবন্দী দিয়েছেন বলে তিনি জানান। বুধবার সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় আদালতে তিনি জবানবন্দী ও জেরার জবাব দেন।
এরপর ৩ জন আসামী এবং ২ জন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী গ্রহণ করা অপর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রট মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীম এর আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু হয়। বুধবার সন্ধ্যা ৬ টায় এ প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রট মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীমকে আসামীদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা আদালতে জেরা করছিলেন।
এই ২ জন বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সিনহা হত্যা মামলার ১৫ জন আসামীর মধ্যে ১২ জন আসামীর এবং ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬ জন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেছিলেন। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: দেলোয়ার হোসেন শামীম ও তামান্না ফারাহ কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে জ্যৈষ্ঠ বিচারিক হাকিম হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। বিজ্ঞ বিচারক তামান্না ফারাহ আদালতে দাখিলকৃত চার্জশীটের ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৭৬ নম্বর এবং মো: দেলোয়ার হোসেন শামীম ৭৭ নম্বর ক্রমিকের সাক্ষী।
রাষ্ট্র পক্ষে মামলাটির আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) এডভোকেট ফরিদুল আলম, অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট মোজাফফর আহমদ হেলালী, এপিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ সাক্ষী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ এর
জবানবন্দী গ্রহণ করেন। এসময় বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস এর আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা, এডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এডভোকেট সৈয়দুল ইসলাম, এডভোকেট এসমিকা সুলতানা এডভোকেট শাহ আলম, এডভোকেট আবুল আলা জাহাঙ্গীর প্রমুখ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, আসামীদের পক্ষে আদালতে এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, এডভোকেট দিলীপ দাশ, এডভোকেট শামশুল আলম, এডভোকেট মমতাজ আহমদ (সাবেক পিপি) এডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া, এডভোকেট চন্দন দাশ, এডভোকেট এম.এ বারী, এডভোকেট নুরুল হুদা, এডভোকেট ওসমান সরওয়ার আলম শাহীন, এডভোকেট মোশাররফ হোসেন শিমুল, এডভোকেট ইফতেখার মাহমুদ প্রমুখ সাক্ষী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ’কে জেরা করেন। সাক্ষ্য গ্রহণকালে মামলার ১৫ জন আসামীকেও কড়া নিরাপত্তায় আদালতে হাজির করা হয়।
পিপি এডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, বুধবার ২৭ অক্টোবর ৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। সময়ের অভাবে বাকী সাক্ষীরা হয়ত বুধবার আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারবেন না। বুধবার আদালতে উপস্থাপন করা অন্যান্য সাক্ষীরা হলো-তৎকালীন টেকনাফ থানায় এই মামলা রেকর্ডকারী ওসি এস.দোহা, তৎকালীন ডিবি’র ওসি মানস বড়ুয়া, জব্দ তালিকার সাক্ষী এসআই কামাল হোসেন ও কনস্টেবল মোশাররফ হোসেন।
নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ এর আদালতে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর : এসটি-৪৯৩/২০২১ ইংরেজী। যার জিআর মামলা নম্বর : ৭০৩/২০২০ ইংরেজি। যার টেকনাফ মডেল থানা মামলা নম্বর : ৯/২০২০ ইংরেজি। মামলাটি তদন্তভার দেওয়া হয় র্যাব-১৫ কে।
যে ১২ জন আসামী ১৬৪ ধারায় আদালতে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিলেন তারা হলেন : বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
আর যে ৩ জন আসামী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেননি, তারা হলো : টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও কনস্টেবল সাগর দেব। আদালতে চার্জশীট জমা দেওয়ার পর গত ২৪ জুন কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করে।
এদিকে, ২ জন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও এর আগে গত ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত এ মামলায় আরো মোট ৫৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন করা হয়। আগে আরো যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা হলেন-মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী সাহিদুল ইসলাম সিফাত, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ আমিন, মোহাম্মদ কামাল হোসেন ও হাফেজ শহীদুল ইসলাম, আবদুল হামিদ, ফিরোজ মাহমুদ ও মোহাম্মদ শওকত আলী, হাফেজ জহিরুল ইসলাম, ডা. রনধীর দেবনাথ, সেনা সদস্য সার্জেন্ট আইয়ুব আলী, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. মোঃ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী, মোক্তার আহমদ, ছেনোয়ারা বেগম, হামজালাল, আলী আকবর, ফরিদুল মোস্তফা খান, বেবী ইসলাম, সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মোঃ মুনতাসীর আরেফিন, সার্জেন্ট মোঃ মোক্তার হোসেন, কর্পোরাল নুর মোহাম্মদ, সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার সৈয়দ মঈন, সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আবু জাফর এবং লেন্স কর্পোরাল মোঃ রুহুল আমিন, আহমদ কবির মনু, ধলা মিয়া, সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট মোঃ জিয়াউর রহমান, সার্জেন্ট আনিসুর রহমান, কনস্টেবল কামরুল হাসান, রামু সেনানিবাসের ১০, এমপি ইউনিটের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ ইমরান হাসান, র্যাব-১৫ এর এএসআই নজরুল ইসলাম, এসআই সোহেল সিকদার, পুলিশের কনস্টেবল শুভ পাল, এসআই মোঃ আমিনুল ইসলাম ও একই থানার কনস্টেবল পলাশ ভট্টাচার্য, জব্দ তালিকার সাক্ষী কনস্টেবল উসালা মার্মা, সেনা সদস্য হীরা মিয়া, র্যাব-১৫ এর নৌবাহিনীর সদস্য আবু সালাম, কাউন্টার ম্যানেজার নবী হোসেন, আবুল কালাম ও শহীদ উদ্দিন, সিনহাকে খুনের আগে-পরে বিভিন্ন জনের মোবাইল ফোন রেকর্ডকারী গ্রামীণ ফোনের প্রতিনিধি মোঃ আহসানুল হক, রবি অপারেটরের প্রতিনিধি সৈকত আহমদ শিপলু, রাসায়নিক পরীক্ষক মিজানুর রহমান ও পিংকু পোদ্দার, কনস্টেবল সাখাওয়াত হোসেন, এসআই বাবুল মিয়া, এসআই রাশেদুল হাসান, এসআই হাশেম, এসআই মোহাম্মদ মুছা, এসআই আবদুল জলিল, এসআই আবদুল্লাহ আল হাসান, এএসআই মোঃ বাবুল মিয়া, এসআই নাজমুল হোসেন এবং এসআই সুমন কান্তি দে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার এম. নুরুল কবির জানান-এ মামলার চার্জশীটের ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮১ নম্বর পর্যন্ত সাক্ষীকে সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য সমন দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) র্যাব-১৫ সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ আমিনুল হক এবং দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) র্যাব-১৫ সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ খায়রুল ইসলামকে আদালতে সাক্ষ্য দিতে এখনো সমন দেওয়া হয়নি।
গত ২৩ আগস্ট সকালে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক এ বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।